“হুমায়ূন আহমেদের সাথে কিছুক্ষন” – শরীয়তপুরবাসী লেখক আবদুুর রব শিকদারের স্মৃতিচারণ
1 min read১৯৬৫ সালের জুলাই আগষ্ট মাস।আমি এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম বিভাগ পাওয়ার সুবাদে ঢাকা কলেজে ভর্তির সুযোগ পাই।আমার চেয়েও ভালো রেজাল্ট করে কয়েক’শ’ ছেলে ঢাকা কলেজে আইএসসি,আইএ ও আইকমে ভর্তি হয়। নতুন করে ক্লাস শুরু হয়েছে।এরমাঝে কয়েকজনের সাথে বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে।
ওই সময়ে চোখে মোটা কাঁচের চশমা, হালকা ফুল সার্ট,ফুল প্যান্ট ও কালো ফিতা ওয়ালা জুতা সহ চটপটে এক তরুণকে শত ছেলের মাঝেও কেমন জানি আমার মনে রেখাপাত করে। ও তখন এসএসসিতে ষ্টান্ড করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। কলেজের প্রিন্সিপাল তখন জনাব জালাল আহমেদ। তাঁর রুমের সামন দিয়ে হাঁটছি। প্রথম দেখি হুমায়ূন ওই করিডরে হাঁটছে। প্রথম দেখায়ই মনে হলো ওর মুখশ্রী খানি অনেকের চেয়ে উজ্জ্বল। যদিও সে আর আমি উভয়েই আইএসসি পড়ি, তথাপি সে অন্য সেকশনে ছিল। কেবলমাত্র কেমিস্ট্রি সাবজেক্টের ক্লাস নেওয়ার সময় আমি তাঁকে দেখেছি। ওই বছর পাকিস্তান -ভারত যুদ্ধ হয়। কলেজের সামনে মাটি খুঁড়ে বাংকার বানানো হয়েছিল সে বছর। রাতে ব্লাক আউট। সারা নিউমার্কেট এলাকা ব্লাক আউট।এসব দেখেছি তখন। বিভিন্ন কারণে আমার ঢাকা কলেজে ক্লাস করা সম্ভব হয়নি।আমি মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন কলেজে পরবর্তী পড়াশোনা করি।
এরপর বহুদিন চলে গেল।১৯৯৩ সাল। হুমায়ূন তখন সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার মধ্য গগণে। আমি এমএ পাস করে কর্মজীবনের মাঝখানে।একটা বই আমার প্রকাশিত হয়েছে।দ্বিতীয়টি প্রকাশনার পথে।বইটি একটি দীর্ঘ প্রেম পত্র।ইতি তোমারই নাঈম।বইটির উপর মুখবন্ধ লেখার কথা চিন্তা করে ভাবলাম, হুমায়ূনকে দিয়ে এটা লেখালে কেমন হয়।যেই চিন্তা সেই কাজ।হুমায়ূন তখন ধানমন্ডি এলিফ্যান্ট রোড বাটার মোড়ে এক নতুন ফ্লাট দখিনা হাওয়ায় তার সহধর্মিণী গুলকেতিন ও শিশু বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন।এক বিকেলে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে পুরনো সহপাঠী হুমায়ূনের বাসায় গেলাম।পরিচয় দেয়ার পর অস্পষ্ট স্মৃতিতে তিনি আমাকে স্মরণে আনলেন। তাঁর তিন রুমের ফ্লাটে ড্রয়িং রূমে গিয়ে দেখি বসার কোন চেয়ার বা সোফা নেই। ফ্লোরে বসে ল্যাপটপে তিনি একটানে একেকটা উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন। সিগারেটের পর সিগারেট তাঁর মুখে।বেশ সিগারেট খেতেন তিনি।
তাঁকে আমি আমার বইটি প্রসঙ্গে ধারণা দিলাম।তিনি সিগারেটে টান দিয়ে বিষয়টি ভাবলেেন। দূরে দেখি গুলকেতিন ভাবি গৃহকাজে ব্যস্ত।কাজের বুয়া আমাকে মিষ্টি সহ নাস্তা এনে দিলেন। আমার অনুরোধে হুমায়ূন বললেন,”দেখো আমি সাধারণত এরূপ মুখবন্ধ লেখিনা।তুমি দেখো আমি কোন সভা সমাবেশে প্রধান অতিথি,বিশেষ অতিথি বা আলোচক হিসেবে যাইনা।আমি মনে করি এতে খামোখা সময়ের অপচয়। এর চেয়ে ওই সময়ে কিছু লেখলাম যা আমার কাজ হিসেবে রয়ে যাবে।” তাঁর এ কথার পর আমি আর কোন কথা বললাম না।
একটু পরেই দেখলাম তাঁর বাসায় সুদূর খুলনা হতে আসা এক নবম শ্রেণির ছাত্রী এসে সালাম দিয়ে দেখা করছে। হুমায়ূন মেয়েটির কথা শুনলেন। উপদেশ দিলেন বাইরের বই পড়তে আর লেখার প্রাকটিস করতে।
লক্ষ্য করলাম হুমায়ূন সব সময় কিছু না কিছু ভাবতেন। কোন জবাব ভেবে চিন্তে দিচ্ছেন না।কেমন জানি সব সময় সৃজনশীল কিছু না কিছু ভাবনা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতো। একটু অগোছালো স্বভাবের আর তিনি যা ভাবেন তাই যেন ঠিক এরূপ তিনি বুঝাতেন।
ছাত্র বয়সে যে মোটা চশমা পড়তেন ঠিক সেই মোটা চশমা তখনও চলছে।অধিকতর মোটা কাঁচ বই কি।
এরপর বহু কিছু।অনেক অনেক সৃষ্টি তাঁর মাধ্যমে আমরা পেলাম।এরপর কঠিন ক্যান্সারের শিকার হয়ে তাঁকে চলে যেতে হলো অপর পাড়ে। এতদসস্ত্বেও কলেজ জীবনের সেই সহপাঠী বন্ধুটা আমার আজ বাংলা সাহিত্য আর সংস্কৃতির অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র।
আজ ১৯ জুলাই সেই বন্ধু হুমায়ূন আহমদের দশম মৃত্যুবার্ষিকী।তিনি ঘুমিয়ে আছেন তাঁরই গড়া গাজীপুরের নুহাশ পল্লীতে নিভৃতে।আহা তিনি যদি বিশ্ব কবির মতো আশি বছর বয়স পেতেন,তা হলে কতো সমৃদ্ধই না করে যেতে পারতেন বাংলাদেশের সতন্ত্র চরিত্রের সাহিত্য আর সংস্কৃতিকে।
বন্ধু হুমায়ূন তুমি ঘুমাও। আমরা তোমার স্মৃতিকে এগিয়ে নেবো। তুমি ওপারে ভালো থেকো।
লেখক: আবদুর রব শিকদার
( মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিশিষ্ট লেখক, কবি, সংগঠক এবং সমাজনেতা)
লেখক ঠিকানা: লাকার্তা, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর ।
১৯,৭,২০২২
সংবাদ সম্পর্কে আপনার মতামত