বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রপতিকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাতে প্রস্তুত বঙ্গভবন

ডেস্ক রিপোর্ট//  বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে রাজসিক বিদায় জানাবে বঙ্গভবন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রপতিকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো হচ্ছে। বিদায় অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন।

সোমবার বেলা ১১টায় বঙ্গভবনে শপথ নেবেন নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। দায়িত্ব হস্তান্তরের পর বঙ্গভবন ছেড়ে আবদুল হামিদ সেদিন উঠবেন রাজধানীর নিকুঞ্জে তার নিজের বাড়িতে।

বিদায় বেলায় প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের একটি সুজ্জিত দল বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল মাঠে গার্ড অব অনার দেবে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান আবদুল হামিদকে; বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে তাকে দেওয়া হবে স্যালুট গার্ড। সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী তাকে পৌঁছে দেওয়া হবে নতুন ঠিকানায়।

প্রেস সচিব গণ মাধ্যম কে বলেন, “দেশের একুশতম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে স্মরণীয় বিদায় জানানোর সব প্রস্তুতি নিয়েছে বঙ্গভবন। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রপতি, যিনি দুই মেয়াদ ১০ বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের এটা স্মরণীয় ঘটনা। ৫২ বছরে আর কোনো রাষ্ট্রপতির বঙ্গভবনে এরকম বিদায় অনুষ্ঠান হয় নাই।”

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মো. আবদুল হামিদ প্রথম দফায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। দ্বিতীয় দফায় তিনি শপথ নেন ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল। রোববার তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে।

বিদায় অনুষ্ঠানের পর্ব শুরু হবে সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায়। গার্ড অব অনার দেওয়ার পর বিদায়ী রাষ্ট্রপতি পুষ্পসজ্জিত খোলা জিপে বক ফোয়ারা থেকে বঙ্গভবনের প্রধান ফটক পর্যন্ত যাবেন। সেখানে বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা হবে সামরিক কায়দায়।

বঙ্গভবনের কর্মকর্তারা দুই দলে ভাগ হয়ে গাড়ির সামনে দড়ি ধরে দাঁড়াবেন। তারাদড়ি ধরে এগিয়ে গেলে পেছনে পেছনে যাবে গাড়ি। বঙ্গভবনের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পিজিআর সদস্যরা এ সময় ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেবেন।

সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ব্যান্ড দল এবং অশ্বারোহী দল অংশ নেবে রাষ্ট্রপতি হামিদের বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায়।

বঙ্গভবনের প্রধান ফটক থেকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের তত্ত্বাবধায়নে ভিভিআইপি গাড়িতে মোটর শোভাযাত্রা করে বিদায়ী রাষ্ট্রপতিকে নিকুঞ্জে তার বাসভবনে পৌঁছে দেওয়া হবে।

প্রেস সচিব জানান, ২৪ এপ্রিল নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শপথ গ্রহণের পর তার গুলশানের বাসায় ফিরে যাবেন। এরপরই শুরু হবে বিদায়ী রাষ্ট্রপতির বিদায় অনুষ্ঠান।

বঙ্গভবন ছেড়ে আবদুল হামিদ উঠবেন তার নিকুঞ্জের বাড়িতে |
রাষ্ট্রপতি হামিদের বিদায় অনুষ্ঠান স্মরণীয় হয়ে থাকবে মন্তব্য করে তার প্রেস সচিব বলেন, “এটা এই কারণে স্মরণীয় যে ৫২ বছরে বাংলাদেশে ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্রপতির এভাবে বিদায় হয় নাই।”

আবদুল হামিদের আগে বাংলাদেশে ২০ জন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের কেউ কার্যত আনুষ্ঠানিক বিদায় পাননি।

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

তৃতীয় রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার মেয়াদ শেষ না করেই ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিদায় নেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের বিংশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন আবদুল হামিদ আর সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তন হলে মেয়াদ পূর্ণ না করেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বিদায় নেন চতুর্থ রাষ্ট্রপতি মুহম্মদউল্লাহ। সে সময় আবারও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে ৬ নভেম্বর তাকে বিদায় নিতে হয়।

পরে রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম, তাকে সরিয়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল ক্ষমতায় বসেন সেনা শাসক জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি হত্যার শিকার হন। তারপর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তাকে সরিয়ে তখনকার সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এএফএম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসান। পরে তাকে সরিয়ে নিজেই দেশের রাষ্ট্রপতি বনে যান ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর।

তীব্র গণআন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আসেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে। পরে নির্বাচন দিয়ে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরে যান।

সে সময় বাংলাদেশ আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরে। ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রহমান বিশ্বাস।

মেয়াদ শেষে তার বিদায়ের পর তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার আবারও রাষ্ট্রপতি করে সাহাবুদ্দীন আহমদকে। তার আগেই তিনি সুপ্রিম কোর্ট থেকে অবসরে গিয়েছিলেন। পাঁচ বছর রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব সামলে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি বিদায় নেন।

এরপর বিএনপি আমলে রাষ্ট্রপতি হন একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কিন্তু সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে ২০০২ সালের ২১ জুন তিনি পদত্যাগ করে বঙ্গভবন ছাড়েন।

বদরুদ্দোজার বিদায়ের পর মো. জমিরউদ্দিন সরকার ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বিএনপি রাষ্ট্রপতি করে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে। মেয়াদ শেষে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বিদায় নেন।

আবদুর রহমান বিশ্বাস, সাহাবুদ্দীন আহমদ ও ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেও তাদের বিদয়ে কোনো আনুষ্ঠানিকতা হয়নি। অনেকটা নীরবে তাদের বঙ্গভবন ছাড়তে হয়।

২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন জিল্লুর রহমান। চার বছরের মাথায় তার মৃত্যু হয়।

এরপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মো. আবদুল হামিদ। টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেন, যা তার আগে কেউ করেনি।

সংবাদ সম্পর্কে আপনার মতামত

Copyright © All rights reserved. | Newsphere by AF themes.